প্রকাশিত: Fri, Jan 6, 2023 4:19 PM
আপডেট: Sun, May 11, 2025 11:17 AM

কনকনে শীতে দরিদ্র মানুষের কষ্ট আমরা কি দাঁড়াবো না তাদের পাশে?

অজয় দাশগুপ্ত

যারা মনে করেন, কলাম বা চলমান লেখালেখি মানে রাজনীতি বা দলীয় চর্চা আমি তাদের দলে পড়ি না। এটাও মানি নাÑ কলাম মানে নিরন্তর সমালোচনা বা নিন্দা করা। এটা স্বীকার করি সবাই মিলেই এমন এক আবহ তৈরি করে ফেলেছি আমরা। আমার মনে হয়, মানুষ তেমন লেখাগুলো পড়েন এবং পড়তে ভালোবাসেন যা  তাদের মন স্পর্শ করতে পারে। আমি যখন এ লেখা লিখছি তখন বাংলাদেশে কনকনে শীত। টিভিতে দেখলাম, শীতে কাবু মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবসহা। উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণ বঙ্গের শীত প্রায় ফি বছরই শিরোনাম হয়ে যায়। এ বছর খোদ ঢাকাকেও ছাড় দিচ্ছে না দেখতে পাচ্ছি। রাজধানী শহরের বড়লোক বা মধ্যবিত্তরা শীতের সকাল রাতে কফির কাপ কিংবা ধোঁয়া ওঠা বারবিকিউর ফটো দিয়ে নিজেদের দুঃখবিলাসের কথা জানাচ্ছেন। মন্দ কী? তা তারা করতেই পারেন। কিন্তু মন খারাপ হলো রাজপথে নিদ্রাকাতর মানুষগুলোকে দেখে। এমন কতো হাজার বা লাখ মানুষ আছেন কে জানে? সংখ্যা নিয়ে যারা বাহাস করতে ভালোবাসেন তারা হয়তো এখনই ঝগড়া শুরু করে দেবেন। হাতে কলমে পরিসংখ্যান দিয়ে প্রমাণ করে ছাড়বেন, আগের আমলগুলোর চাইতে ফুটপাত বা রাজপথের কিনারায় রাত কাটানো মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। নিশ্চয়ই কমেছে। 

এজন্য সরকার ও সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ। কিন্তু কমতে কমতেও থেকে গেছে অনেক মানুষ। যাদের রাতে কোথাও যাবার জায়গা নাই। টিভিতে দেখলাম গাড়ি করে এসে যারা শীতবস্ত্র দিচ্ছেন তাদের ঘিরে আছে বেশকিছু মানুষ। চেহারা দেখলেই বোঝা যায় তারা কতটা কাবু। আপনি একবার ভাবেন এমন শৈত্যপ্রবাহ আর ঠাণ্ডায় আপনি আমি যেখানে ঘরে থাকতে পার্িছ না তখন এই মানুষগুলো খোলা রাস্তায় কনকনে শীতের হাওয়ায় কীভাবে রাত কাটান? আজকাল সামাজিক মিডিয়ার যুগ। সামাজিক মিডিয়ায় মানুষ পোস্ট দেয় না এমন বিষয় নাই বললেই চলে। এসব পোস্টে কাজও হয়। এটা তো প্রমাণিত সত্য যে খবরের কাগজ এমন কি বহু চলমান দৃশ্যমান মিডিয়ার চাইতেও শক্তিশালি ফেসবুক ইনস্টিগ্রাম বা ট্যুইটার। দেশের ভেতর সংঘটিত কতো অন্যায় অপমান আর বেদনার প্রতিকার করে ছেড়েছে সামাজিক মিডিয়া। বিশেষত: ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা বা বিজ্ঞানহীনতার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা জনমত অনেক পরিবর্তন সম্ভব করে ছেড়েছে। অথচ  এমন একটা মানবিক বিষয় নিয়ে কেন নীরব থাকবে বা থাকি আমরা?  

দুনিয়ার বহুদেশে এখন ছিন্নমূল মানুষেরা রাস্তায় থাকেন। হোমলেস মানুষ সিডনিতেও আছেন। কাজে যাই ভোর সাতটার আগে। বাংলাদেশের চাইতে অনেক বেশি শীত আর কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে তিন চার স্তরের কাপড় পরিহিত আমারই খবর হয়ে যায়। পথে ঠিক ওরা ধাকে না থাকে ছাদের তলায়। কিন্তু আমি যেটা খেয়াল করি, প্রায় সবাই পর্যাপ্ত গরম কাপড়ে ঢাকা। তাদের গায়ে ব্র্যান্ডের পোশাক। পায়ে দামি কেডস। বোঝাই যায় এরা সরকারের অনুদান পায়। হয়তো তা নানা অকাজে খরচ করে ফেলে অথবা কুলিয়ে উঠতে পারে না। এমন মানুষগুলোকে কয়েকদিন বা মাস খানেক পর আর দেখা যায় না। এর কারণ সরকারি তরফে খবর গেলেই পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজন এসে হাজির হয়ে যায়। তাদের ধরে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় হাউজিং কমিশন নামের বাড়িগুলোব। যে সব বাড়ি ঘর দেখে বোঝার উপায় নাই এগুলো কি কারো কেনা বাড়ি না সরকারি কমিশনের হাউজিং। বরং এমনও দেখেছি এদের অনেকেই যেতে নারাজ। হয়তো শেডের তলায় স্টেশন বা জনবহুল এলাকায় দিনের বেলা ভালো পরিমাণ  ডলার জোটে বলেই এরা যেতে চায় না। ধরে বেঁধে আসামীর মতো করে কোনো একটি বাড়িতে নিয়ে যাবার দৃশ্যও দেখেছি। আমাদের দেশে সরকারের আন্তরিকতা থাকলেও এমনটা সম্ভব না । যাদের কথা বলছি তারা হতদরিদ্র। তাদের সংখ্যাই বেশি। এরা ভালো না থাকলে দেশ বা সমাজ ভালো থাকে কী করে? যে আয় উন্নতি প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয় তা বাস্তব  হলে এদের এই শীতকাল কেন এমন কষ্টে কাটবে? কিন্তু এটাতো ঠিক এখন এই এখন ই ঢাকায় এমন উৎসব হচ্ছে যার টিকেটের দাম দশ হাজার টাকা। এমন সব খেলার আসর বিনোদনের আসর যাদের টিকেটের দাম আকাশ ছোঁয়া হলেও মেলা ভার। এসব মানুষদের সবাই না হোক একটা অংশ যদি তাদের উপচে পড়া অর্থের কিছু দান করতেন তো রাজধানীর এই শীতার্ত মানুষগুলোর শরীরে কাপড় থাকতো। আমাদের সমাজে ধনী মানুষ মূলত কারা? এর উত্তর আমাদের দিতে হবে না। এর জবাব একটি শিশু ও দিতে পারবে। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছের দিন ও শেষ। এখন আঙ্গুল ফুলে বটগাছের যুগ। এইসব বটগাছের কোন খবর নাই। কোন ক্রান্তিকালে এদের খবর থাকে না। এরা দেশের টাকা ব্যাংকের টাকা পাচার করে নিজেরা তেল ঘিয়ে থাকে বটে গরিব বা দরিদ্রদের জন্য এদের মন খারাপ হয় না। এদের টাকায় গরিবের হক থাকলেও  তারা এর পরোয়া করে না। এরা একবেলার খাবারের টাকা বা একদিনের অপচয় দান করলেও সমস্যার অনেকটা সমাধান হতে পারতো। 

আর একটা কথা সবসময় সময় এলে বা মানুষ কষ্ট পেলে তখন তা নিয়ে ভাবনা করতে হবে কেন? শীতকাল তো বলে কয়েই আসে। কষ্টের খবরও নতুন কিছু না। আগেভাগেই কি প্রতিকারের কাজ শুরু করা যায় না? যায় নাকি একমাস আগেই মানুষকে শীতবস্ত্র তুলে দেওয়া? তাহলে আজ এই কনকনে শীতে হাঁড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় এদের খবর শিরোনাম হতো না। তারাও বাঁচতে পারতো। উন্নতি উন্নয়ন এসব কাগজ কলমের বিষয় না। এর সঙ্গে চাই আন্তরিকতা। চাই সম্মিলিত ভালোবাসা। যে মানুষগুলো এদের জন্য ভাবে বা যাদর মন কাঁদে তারা নিজেরাই অসহায়। আর যাদের শক্তি টাকা ও বিত্ত আছে তাদের হৃদয় নাই। এই দুই অংশের সমঝোতা আর মিলনেই আমরা শীতে কাবু মানুষদের পাশে দাঁড়াতে পারি। মানুষ মানুষের জন্য এই কথা কি সত্য হবে না? সিডনি।